'কেঁচো' প্রাণীজগতে সবচেয়ে প্রভাবশালী। এটাকে বলা হয়" মাটি প্রকৌশলী " -শায়খ মুসা আল-হাফিজ

Published from Blogger Prime Android App
কী বিরক্তিকর প্রাণি এটি! পৃথিবীতে কী দরকার ছিলো ? - বলে অনেকেই। বিভিন্ন প্রাণির প্রতি ঘৃণা ও তচ্ছিল্য থেকে এমন কথা আসে। ধরা যাক কেঁচোর কথা। সে সাধারণত তুচ্ছ বিবেচিত হয়। প্রশ্ন আসে, আল্লাহ কেন একে বানালেন? 

কেঁচো আসলে তুচ্ছ নয়, প্রাণিজগতে সে সবচে‘ প্রভাবশালী। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা  অমেরুদণ্ডী এই  প্রাণিকে স্থান দিয়েছেন ডাইনোসরেরও ওপরে!  কৃষি যে বেঁচে আছে, সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সবচে বেশি অবদান কেঁচোর।।  মাটির উর্বরাশক্তি বাড়াতে তার ভূমিকা অতুলনীয়।  প্রকৃতির লাঙল উপাধী সে লাভ করেছে আপন গুনেই। যদিও তার  চোখ নেই, কান নেই,   ফুসফুস নেই। আসলে নাকও নেই,  ত্বক দিয়েই গ্রহণ করে শ্বাস-প্রশ্বাস ।    বিজ্ঞান তার  নাম  দিয়েছে Metaphir posthuma। 

 সাধারণত ফসলি জমি বা ঘরবাড়ীর  কাছে ভেজা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় সে থাকে। ক্ষয়ে যাচ্ছে, এমন  মাটি বসবাসের জন্য পছন্দ এদের,  যেখানে থাকে প্রচুর জৈব পদার্থ । সাধারণত সাত-আট ইঞ্চি লম্বা হয় এরা।এদের দেহ নলের মতো লম্বা, সরু । দেহের সামনের দিক একটু চাপা, পেছনের দিক  কিছুটা ভোঁতা। পীঠে রক্তনালিকার গাঢ় মধ্যবর্তী রেখা,  যা থাকে  চামড়ার নিচে । দেহের সামনের দিকে নিচভাগে থাকে  জনন ছিদ্র আর  প্যাপিলা ।
  তারা গর্ত বানাতে পারে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০-৪৫ সেন্টিমিটার গভীর হয় তাদের গর্ত । এদের রক্ত শীতল।তাদের সবচে‘ ভালো সময় বর্ষাকাল। তারা  আলো সহ্য করতে পারে না, তাপ এদের সমস্যা।   দিনে তাই  গর্তে  থাকে। রাতে বের হয় খাবারের জন্য।
কী খায় কেঁচো?  গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, ধান ও গমের খড়, মুগ, কলাই, সরিষা ও গমের খোসা, তুষ, ভুসি, সবজির খোসা, লতাপাতা, আখের ছোবড়া ইত্যাদি। বেশির ভাগ খাবারই মরা ও আধাপচা। এগুলো পরিষ্কার করে  মাটিতে সে জৈব পদার্থ দান করে। 
 সে যে মল ত্যাগ করে,  তাকে কাস্ট বলে। এ কাস্টে  জীবাণু সংখ্যা এবং তাদের কার্যকলাপ বাড়ে,  মাটির উর্বরতাও বাড়ে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, অন্যান্য  মাটির তুলনায় কাস্টের মধ্যে জীবাণু সংখ্যা প্রায় হাজার গুণ বেশি। এ কাস্টের কারণে মাটি থেকে গাছে ৬ শতাংশ নাইট্রোজেন এবং ১৫-৩০ শতাংশ ফসফরাস যোগ হতে দেখা গেছে। এতে  রয়েছে  বহুবিধ জৈব রাসায়নিক পদার্থ, উসচক, নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী সাইট্রিফাইং ও অ্যামোনিফাই ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক ধরনের জীবাণু ও উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক ইনডোলের যৌগ উপস্থিতি।  যা  মাটির উর্বরতা অনেক বাড়িয়ে দেয়।

তাদের শত্রুর অভাব নেই।  পিঁপড়া, উইপোকা, তেলাপোকা, গোবরাপোকা, চিকা, মুরগি আর  বিভিন্ন পাখি তাদের বাগে পেলে খেয়ে নেয়। এই খাবারটা তাদের জন্য খুবই উপাদেয়। নরম ও পুষ্টিকর। 

 অধিকাংশ প্রজাতির কেঁচো   এক থেকে দুই বছর বাঁচে।  কোনো প্রজাতির জীবন  চার থেকে আট বছরের।

  এই সংক্ষিপ্ত জীবনে বেঁচে থাকা ও চলাফেরার    মাধ্যমে সে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব প্রক্রিয়ায়  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । সে যেখানে যায়, সেখানে  মাটিতে বায়ু চলাচল, পানির অনুপ্রবেশ ও শিকড়ের বৃদ্ধি ঘটে ।  মাটিকে সে আলগা, ফাঁপা ও নরম করে দেয়।জৈব উপাদান ভেঙে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও পুষ্টি উপাদানের জোগান দেয়।  মাটির এমন গভীরে  আলো-বাতাস ও পানি যেতে পথ করে দেয়, সেখানে উদ্ভিদ ও তরুলতার শেকড় বিস্তৃত হতে চায়। 
মাটির ভেতর দিয়ে চলাফেরার সময় সে  মাটি ভাঙে এবং মেশায়। এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং বন্যা ও ভাঙন রোধ হয়। এ জন্য এর আরেক নাম  ‘মাটি প্রকৌশলী’ । এদের মাটির স্বাস্থ্য এবং বিষাক্ততা পরিমাপকও বলা চলে।পরিবেশ দূষণ রোধে সে ভূমিকা রাখে। সিসার মতো ক্ষতিকর উপাদানের প্রভাব  মাটি থেকে দূর করে দেয়।

সাধারণত  তিন মিটার পর্যন্ত মাটি কর্ষণ করতে পারে কেঁচো। এর ফলে মাটিতে বাড়ে কৃষিউপযোগ, আসে উর্বরতা। সে চলমান এক উর্বরতার প্রতিক।  

আমরা, মানুষেরা কী করেছি?  জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিচ্ছি। ফলে সে বিপন্ন হচ্ছে। সাথে হচ্ছি আমরাও! 
কিন্তু এখানেও সে সহায়ক হিসেবে নিজেকে হাজির করে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের আপদ থেকে আমাদের তো বাঁচতে হবে। 

 
  অতএব এর বিকল্প হলো, বিশেষ প্রজাতির কেঁচোর সাহায্যে  উদ্ভিদ ও প্রাণিজ বিভিন্ন প্রকার জৈববস্তুকে সারে রূপান্তর করা। কম সময়ে তা জমিতে ব্যবহার করা যায়। এর মানও খুব উন্নত।  এক বিচারে সে আশীর্বাদ। 
  কারণ আদর্শ ভার্মিকম্পোস্ট বা   কেঁচোসারে রয়েছে  জৈব পদার্থ ২৮.৩২ ভাগ, নাইট্রোজেন ১.৫৭ ভাগ, ফসফরাস ১.২৬ ভাগ, পটাসিয়াম ২.৬০ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২ ভাগ, ম্যাগনেসিয়াম ০.৬৬ ভাগ, সালফার ০.৭৪ ভাগ, বোরন ০.০৬ ভাগ, আয়রন ৯৭৫ পিপিএম, ম্যাঙ্গানিজ ৭১২ পিপিএম, জিঙ্ক ৪০০ পিপিএম এবং কপার ২০ পিপিএম রয়েছে।
এগুলোর সবই উদ্ভিদের আবশ্যকীয় খাদ্যউপাদান। বস্তুত গাছের জরুরী  ১৬টি খাদ্য উপাদানের ১০টিই কেঁচোসারে  বিদ্যমান।

আমরা জমিকে উত্পাদনের যোগ্য করি, খেত-খামার ও বাগান করি, বৃক্ষ-তরুলতা ও  শস্য ফলাই। আসলে আমরাই তা  করি? আমরাই শস্য ফলাই? 
এর পেছনে কতো বিপুল আয়োজন প্রকৃতির, যার নিয়ন্তা মহান প্রভু। প্রতিটি সৃষ্টিকেই তিনি কাজে লাগিয়ে রেখেছেন। আমাদের সবকিছুতে তাদের বিচিত্র অবদান।

আমরা শুধু ভোগ করবো, কৃতজ্ঞ হবো না?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

 ৫ মামলায় মামুনুল হককে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট

Body Smell: ৩ খাবার: নিয়মিত খেলে দূর হবে ঘামের দুর্গন্ধ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন হওয়া উচিত ছিলো -মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি