কন্সট্যান্টিলোপল জয়ের ইতিহাস! -রাষ্ট্রচিন্তক ও গবেষক শেখ ফজলুল করীম মারুফ

Published from Blogger Prime Android Appআজ ২৯ মে। 

এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় উম্মাহর এক গৌরবময় অধ্যায়ের। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের আজকের এই দিনেই উসমানী সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ রহ. এর নেতৃত্বে মুসলিমরা কন্সট্যান্টিনোপল জয় করে যে বিজয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ ﷺ ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন।
لتفتحن القسطنطنية فلنعم الأمير أميرها ولنعم الجيش ذلك الجيش
“নিশ্চয়ই তোমরা কন্সট্যান্টিপোল বিজয় করবে।তার আমীর উত্তম আমীর হবে এবং সেই বাহিনী উৎকৃষ্টতম সেনাবাহিনী হবে।” (মুসনাদে আহমদ ৪/৩৩৫, হাদীস : ১৮৯৫৭; মুসতাদরাকে হাকেম ৫/৬০৩, হাদীস : ৮৩৪৯; মুজামে কাবীর, তাবারানী, হাদীস : ১২১৬)

যুগের পর যুগ ধরে কন্সট্যান্টিনোপল শহরটি ছিল অজেয়। সেই অজেয় কন্সট্যান্টিনোপল অবশেষে মুসলিমদের করতলগত হলো। দিনটি ছিল ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে। সেই মহান বিজয়ের নায়ক উসমানী সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ রহ. যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সেই দুনিয়ার অন্যতম সুরক্ষিত শহরটি জয় করে নেন। মহান এই বিজয়ে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যে ধৈর্য,বিচক্ষণতা ও রণকুশলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা তাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজেতাদের একজনে পরিণত করে।

সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ ৮৩৫ হিজরী সনের রজব মাসের ২৭ তারিখ, ঈসায়ী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪৩২ সনের ৩০ মার্চ উসমানী সালতানাতের তৎকালীন রাজধানী ‘এদিরনে’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন উসমানী সম্রাজ্যের ৬ষ্ঠ শাসক সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ, মাতার নাম হুমা ওয়ালিদা খাতুন।

ছোটবেলা থেকেই দক্ষ শিক্ষক ও আলেমদের অধীনে থেকে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ বড় হন। তার চরিত্র, মানসিকতার উপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল তার শিক্ষক শায়খ আকা শামসউদ্দীনের। তার কাছ থেকেই পাওয়া শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা থেকে কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন সুলতান মুহাম্মদ। 

১১ বছর বয়সে আমাসিয়া প্রদেশের গভর্নর হিসেবে তার পিতা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ তাকে নিযুক্ত করেন। ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুরাদ তার পুত্রের কাছে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ ক্ষমতার প্রথম দফায় খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।

 বেশকিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতান মুরাদ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। অবশেষে, ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুরাদের ইন্তেকালের পর সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ আবারো এদিরনের প্রাসাদে বসেন।
সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের ইন্তেকালের পর সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ উসমানী সম্রাজ্যের সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হয়েই কন্সট্যান্টিনোপল জয়ের লক্ষ্য পূরণে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। আনাতোলিয়ায় সম্রাজ্যের সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য কারামান প্রদেশের আমীরের বিরুদ্ধে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে অভিযানে নামেন।সার্বিয়া ও হাঙ্গেরীর সাথে একটি শান্তিচুক্তির পর তিনি কন্সট্যান্টিনোপল জয়ের জন্য পূর্ণাঙ্গরূপে প্রস্তুতি শুরু করেন।

বসফরাসের এশীয় অংশে সুলতান বায়েজীদ ইয়ালদিরিম আনাদোলু হিসারী নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল। সুলতান মুহাম্মদ বসফরাসের ইউরোপীয় অংশে আরেকটি দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন।বসফরাস প্রণালীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়া ছিল কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বসফরাসের নিয়ন্ত্রণের দ্বারা বাইজান্টাইন সম্রাজ্যকে ইউরোপের অন্য সম্রাজ্যগুলোর সাহায্য হতে দূরে রাখা ছিল সুলতানের একটি কৌশল। ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে রুমেলী হিসারীর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।

আরবান নামক এক হাঙ্গেরীয় নওমুসলিম (কারো কারো মতে সে খ্রিস্টান ছিল) ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্যে সুলতান মুহাম্মদ বেশকিছু বড় কামান নির্মাণ করেন যার মধ্যে একটি কামান ছিল অন্যসব কামানের চেয়ে আকারে অনেক বড়। এটির ওজন ছিল আনুমানিক ১৫০০ কিলোগ্রাম।সুলতান মুহাম্মদ তার সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজান।জেনেসারি বাহিনীর মধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করেন।

কন্সট্যান্টিনোপল শহরের ইতিহাস অনেক পুরনো। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন দ্য গ্রেট শহরটিকে নিজ সম্রাজ্যের রাজধানীতে রূপদান করেন।৩২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শহরটির আবাদ শুরু করেন সম্রাট প্রথম কন্সট্যান্টাইন। যুগ যুগ ধরে এই নগরী ছিল রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী। কন্সট্যান্টিনোপল ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সুরক্ষিত শহর।শহরের তিনদিক দিয়ে ছিল সমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত।শহরটির চারপাশে ২০ মাইল স্থান জুড়ে ছিল দুর্ভেদ্য প্রাচীর।তাদের নৌবহরে ২৬ টির মতো জাহাজ ছিল যেগুলোর কয়েকটি জেনোয়া, ভেনিস এমনকি সুদূর ফ্রান্স থেকেও এসেছিল। বাইজান্টাইন বাহিনীর সৈন্য বাহিনীর কয়েক হাজার ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে আগত এবং ৫০ হাজারের মত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী যারা ছিল শহরের নাগরিক।

 জেনোয়া হতে আগত জিওভান্নি গোয়াস্টিনিয়ানের সাথে ছিল ৭০০ অভিজ্ঞ সৈন্য। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল শহরের সুরক্ষাব্যবস্থা এবং শহরটির কৌশলগত অবস্থান।

অন্যদিকে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ’র বাহিনীতে ছিল ৫০ হজার থেকে ৭০ হাজার সৈন্য যার মধ্যে আনুমানিক ১০ হাজার জেনেসারি ছিল। সুলতানের নৌবহরে ১২৬ টির মতো জাহাজ ছিল। গোলন্দাজ বাহিনীর হাতে ছিল ৭০ টি বিভিন্ন আকারের কামান।

অবশেষে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ সেনাবাহিনী নিয়ে স্থলপথে কন্সট্যান্টিনোপল শহরের কাছে উপস্থিত হন এবং শহরের সেইন্ট রোমানাসের ফটকের বিপরীতে তার শিবির স্থাপন করেন।উসমানী নৌবাহিনী অ্যাডমিরাল সুলাইমান বালুতুঘলুর নেতৃত্বে গোল্ডেন হর্ণের বাইরে মারমারা সাগরে অবস্থান নেয়।

৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয় সুলতান মুহাম্মদের অবরোধ ও গোলাবর্ষণ। কিন্তু একবার কামানগুলো দিয়ে গোলাবর্ষণ করার পর দ্বিতীয়বার গোলাবর্ষণ করতে অনেক সময় লাগতো। এজন্য এতে বিশেষ সুবিধা হয়নি, বাইজান্টাইন সৈন্যরা দ্রুতই দেয়ালের ফাটল মেরামত করে নেয়ার সময় পেত। তাছাড়া শহর প্রতিরক্ষাকারী বাহিনী আগে থেকেই সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। সুলতান মুহাম্মদ পরিখা খনন করে প্রাচীরের কাছে সেনাদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রাচীরের উপর আরোহন করার মত অবস্থা মুসলিম সৈন্যদের ছিল না, বাইজান্টাইন সেনারা তেল গরম করে উসমানী বাহিনীর উপর নিক্ষেপ করছিল তাই বাধ্য হয়ে উসমানীদের সেখান থেকে সরে যেতে হয়।

মারমারায় অ্যাডমিরাল বালুতুঘলুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কন্সট্যান্টিনোপলগামী ইউরোপের যেকোনো জাহাজের গতিরোধ করা। ২০ এপ্রিল সুলতানের কাছে সংবাদ এসে পৌঁছায় যে ৪ টি জেনোয়িস যুদ্ধজাহাজ উসমানী বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে সফলভাবে গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করেছে যেগুলো ছিল রসদ, খাদ্য ও সমরাস্ত্র বোঝাই।

বাইজান্টাইনরা সমুদ্র বন্দরের মোহনায় বিরাট এক লৌহশিকল দুদিক থেকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যার ফলে কোনো জাহাজের বন্দরে প্রবেশ করা ছিল একেবারেই অসম্ভব।মিত্র জাহাজকে বন্দরে প্রবেশের জন্য শিকলকে শহর থেকে আলগা করা হতো এবং বন্দরে পৌঁছানোর পর তা আবারো এমনভাবে টেনে দেয়া হতো যাতে অন্য জাহাজ প্রবেশ করতে না পারে।এই কৌশল যেকোনো তুর্কি জাহাজকে আটকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাছাড়া সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের নৌবহরে জাহাজের সংখ্যা বেশি হলেও সেগুলো ছিল খুব ছোট আকৃতির, এমনকি সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের সবচেয়ে ছোট জাহাজটির সমান কোনো জাহাজও সুলতানের নৌবহরে ছিল না। 

সমুদ্রের দিক থেকে কোনোরূপ আক্রমণের আশংকা না থাকায় বাইজান্টাইন সৈন্যরা তাদের সমস্ত শক্তি স্থলপথে নিয়োগ করেছিল সুলতানের বাহিনীর গতিরোধ করার জন্য। সুলতান বুঝতে পারলেন, এই অভিযানে সফল হবার জন্য তার নৌবাহিনীকে যেকোনো মূল্যে গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করাতে হবেবে।গোল্ডেন হর্ণে উসমানী নৌবাহিনী প্রবেশ করতে পারলে বাইজান্টাইন বাহিনীকে দুইদিক থেকে আক্রমণ করে দু’ভাগে বিভক্ত করে দেয়া যাবে।

সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ এবার এমন এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যার নজির ইতিহাসে আগে কোনোদিন কেউ দেখেনি। সুলতান তার জাহাজগুলো স্থলপথে টেনে গোল্ডেন হর্ণে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলেন। সুলতান মুহাম্মদ তার সেনাবাহিনীকে গাছ কেটে গাছের কাণ্ডগুলো বসফরাস থেকে গোল্ডেন হর্ণের মধ্যবর্তী স্থলপথে সারিবদ্ধভাবে বিছিয়ে দেয়ার আদেশ দিলেন।একাজ সম্পন্ন হবার পর পুরো পথ চর্বি দিয়ে পিচ্ছিল করা হলো। অবশেষে ২২ এপ্রিল রাতে ৮০ টি জাহাজ বসফরাসের তীরে টেনে তোলা হয় এবং জাহাজের নাবিক ও সৈন্যসমেত কাঠের তক্তার উপর উঠিয়ে চার হাজার মানুষ ধাক্কাতে শুরু করে। বায়ু অনুকূলে থাকায় জাহাজের পাল তুলে দেয়া হয়,এতে করে জাহাজগুলো বেশ সাবলীলভাবে দশ মাইল পথ অতিক্রম করে গোল্ডেন হর্ণের সমুদ্রে অবতরণ করে একের পর এক।

সারা রাত জুড়ে উসমানী বাহিনীর হৈ-চৈ, আনন্দ উল্লাস ও হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল কিন্তু গ্রিকরা বুঝতে পারছিল না উসমানী বাহিনী কি করছে। ২৩ এপ্রিল সকালবেলায় বাইজান্টাইন বাহিনী আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করলো প্রায় ৭০-৮০ টি উসমানী রণতরী গোল্ডেন হর্ণের মোহনায় পৌঁছে গেছে।

২৪ মে,১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ। 

সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে দূত পাঠিয়ে শহরবাসীর নিরাপত্তা ও ক্ষমার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব পাঠালেন কিন্তু সম্রাট কন্সট্যান্টাইন কর দিতে রাজী হলেও শহর ত্যাগ করতে রাজী ছিলেন না।

২৮ মে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ। সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ পরদিন ফজরের পর চূড়ান্ত আক্রমণের ঘোষণা দেন।সেনাদের প্রস্তুতি শুরু হয়।সৈন্যদের এই মর্মে শহরে লুঠপাট চালানোর অনুমতি দেয়া হয় যে তারা কোনো ইমারত ধ্বংস করবে না, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের হত্যা করা হবে না, নিরপেক্ষ প্রজারা আনুগত্য স্বীকার করলে তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সম্রাট কন্সট্যান্টাইনও অনুভব করছিলেন শেষ সময়ের।তিনি নিজ জনগণকে আমৃত্যু লড়াই করার জন্য আহব্বান জানান এবং নিজেও একই শপথ করেন।

২৯ মে মধ্যেরাতের পরই উসমানী সেনাবাহিনী সকল ফ্রন্টে আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে যায়। সুলতান মুহাম্মদ ফজরের সালাতের পর আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দু’আ করেন এবং বাছাইকৃত ১০ হাজার সেনার নেতৃত্ব নিজে সরাসরি আক্রমণের দায়িত্ব নিলেন। চতুর্দিক থেকে আক্রমণ শুরু হলো। উসমানী সেনাদের নিক্ষেপ করা কামানের গোলা নগরীর প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে ফাটলের সৃষ্টি করে। উসমানী বাহিনী সেদিক দিয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হয়। বেশকয়েকবার উসমানী সৈন্যরা টাওয়ারে উঠে যেতে সক্ষম হয়েছিল, খ্রিস্টান সৈন্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও সুলতানের সৈন্যদের বাধা দিচ্ছিল। 

স্থলপথে ও নৌপথে ব্যাপক উত্তেজনার সাথে হামলা অব্যাহত ছিল। খ্রিস্টান বাহিনী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে,মুসলিম সেনারাও তাদের বিরুদ্ধে প্রাচীরের মত দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখে। যুদ্ধ তখন চরম পর্যায়ে।উভয় বাহিনী বীর বিক্রমে লড়াই করছিল।সুলতান তার তাঁবুতে প্রবেশ করে সিজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে দু’আ শুরু করেন।

উসমানী গোলন্দাজ বাহিনীর হামলায় প্রাচীরের উত্তর দিকের দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়। আনাতোলিয়ার পদাতিক বাহিনী ও জেনেসারি বাহিনী শহরে প্রবেশ করে খ্রিস্টান সেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে।জেনেসারি বাহিনীর একাংশ সেদিকের একটি টাওয়ারে আক্রমণ করে যা ছিল জেনোয়িস সেনাদের তত্ত্বাবধায়নে ছিল। এই আক্রমণে জেনোয়িস সেনাপতি জিওভান্নি গোয়াস্টিনিয়ান গুরুতর আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ত্যাগে বাধ্য হয়।খ্রিস্টান সৈন্যরা এই অবস্থায় চরম হতাশায় পতিত হয়। গোয়াস্টিনিয়ান ও জেনোয়িস সেনাদের পিছু হটতে দেখে স্বয়ং সম্রাট কন্সট্যান্টাইন এগিয়ে আসেন এবং সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়ে জেনেসারি বাহিনীকে কিছু সময়ের জন্য আটকে রাখতে সক্ষম হন।কিন্তু বেশিক্ষণ তা সম্ভবপর হলো না। 

জেনেসারি বাহিনী ঝড়ের বেগে শহরে প্রবেশ করে। উলুবাতলি হাসান নামক এক জেনেসারি সেনার নেতৃত্বে কিছু জেনেসারি সদস্য একটি টাওয়ার দখল করে সেখানে উসমানীদের পতাকা টানিয়ে দেয়। এটা ছিল খ্রিস্টান সেনাদের মনোবল ভাঙবার চূড়ান্ত আঘাত।উলুবাতলি হাসান ও তার সঙ্গীরা এই আক্রমণে শহীদ হন।শরীরে ২৭ টি তীর নিয়ে দেয়ালে উসমানীদের পতাকা স্থাপন করে সত্যিকারের বীরের মত শাহাদাত বরণ করেন এই সেনা। উলুবাতলি হাসানের এই সাহসিকতা উসমানী সেনাদের মনোবল আরো বাড়িয়ে দেয়।জনশ্রুতি আছে,সম্রাট কন্সট্যান্টাইন তার রাজকীয় বসন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উসমানী সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ সৈন্যদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করে নিহত হন।

যদিও তার ভাগ্যে সত্যিই কি ঘটেছিল তা অজানাই রয়ে গেছে।গ্রিক সৈন্যরা পিছু হটে, ভেনিসের সৈন্যরা তাদের জাহাজের কাছে ফিরে যায়, জেনোয়িস সেনাদের কিছু যুদ্ধ চালিয়ে যায় কিছু আত্মসমর্পণ করে। মুসলিমরা চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে শহরের ফটকগুলো ভেঙ্গে ফেলে। সুলতান এমনই এক ফটক দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শহরে প্রবেশ করেন। শহরে প্রবেশ করে সরাসরি তিনি আয়াসোফিয়ায় চলে আসেন এবং আযান দিয়ে এখানেই যোহরের সালাত আদায় করেন।কন্সট্যান্টিনোপল শহরের প্রধান গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়।

সেদিন প্রায় ৪০ হাজার নগরবাসী নিহত ও ৬০ হাজার বন্দী হয়েছিল। খুব কম খ্রিস্টান সেনাই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
সুলতান শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন।যারা সুলতানের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল তাদের ও তাদের ঘরবাড়ির কোনো ক্ষতি করা হয়নি।আয়াসোফিয়া বাদে বাকী সব উপাসনালয় তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। এমনকি শহরের প্রধান বিশপকে তার পদে বহাল রাখা হয়।

 খ্রিস্টানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন। শহরকে আবাদ করা শুরু করেন। শহরের অনেক ঘরবাড়ি জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছিল। সুলতান সেনাদের কাছে বন্দী হওয়া অনেক বন্দীকে নিজ অর্থে মুক্ত করে দেন। আনাতোলিয়া থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মুসলিম পরিবারকে কন্সট্যান্টিনোপল শহরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়।কায়সারের দুই পুত্র ইসলাম গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে সুলতান বায়েজীদের শাসণামল পর্যন্ত উসমানী সম্রাজ্যে কর্মরত ছিলেন।

আরবিতে শহরের নাম ছিল কুস্তুনতুনিয়া (القسطنطينية)। সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কন্সট্যান্টিনোপল শহরের নাম বদলে ইসলামবুল (اسلامبول) রাখেন যার অর্থ ছিল ‘ইসলামের বাড়ি’।কালের পরিক্রমায় আজ শহরটির নাম ইস্তাম্বুল।সুলতান এই শহরকে উসমানী সম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন যা উসমানী সম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত ছিল এর রাজধানী। অবশেষে পরাক্রমশালী রোমান সম্রাজ্যের পতন হয়।

মুসলিমদের সাথে ৮০০ বছরের দ্বন্দ্বের ফলাফলস্বরূপ পূর্বের খ্রিস্টানদের দুর্গের পতন ঘটে। এই বিজয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ খানের নামের সাথে ‘আল-ফাতিহ’ উপাধি যুক্ত হয় যার অর্থ ছিল বিজেতা। মহান এই বিজয়ের জন্য সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ রহ. আজও মুসলিমদের মাঝে স্মরণীয় হয়ে আছেন মুসলিমদের অন্যতম সেরা শাসক ও বিজেতা হিসেবে।
_________________________________________
তথ্যসূত্রঃ
•Wikipedia – https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fall_of_Constantinople
•Encyclopedia of the Ottoman Empire,Gabor Agoston and Bruce Masters,Page 142-144.
•Encyclopedia Britannica
•ইসলামের ইতিহাস তৃতীয় খণ্ড – মাওলানা আকবর শাহ খান নজিবাবাদী,ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
•তুরস্কের ইতিহাস – ড. এম. আবদুল কাদের,ইসলামিক ফাউন্ডেশন

কৃতজ্ঞতা:-@WMHRC

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

 ৫ মামলায় মামুনুল হককে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট

Body Smell: ৩ খাবার: নিয়মিত খেলে দূর হবে ঘামের দুর্গন্ধ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেমন হওয়া উচিত ছিলো -মুফতি মুহাম্মদ তাকি উসমানি